সারাদেশ

আল্লাহ যদি দুঃখ না বুঝে, তাহলে বান্দা কি বুঝবো?

  রাকিবুল ইসলাম ৬ ডিসেম্বর ২০২৫ , ২:০৯:১৬ প্রিন্ট সংস্করণ

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের চান্দার খাল অঞ্চলজুড়ে নদীর বুকে ভাসমান নৌকার সারি যেন এক ভিন্ন বাস্তবতার ছবি। প্রায় ৫০টি জেলে পরিবার বছরের পর বছর ধরে নৌকাকেই ঘর বানিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। রান্না, ঘুম, বাচ্চাদের কান্না-সবই চলে সরু নৌকার ভেতরেই। তাদের জীবন স্রোতের মতো ভাসমান, অনিশ্চিত, ঝুঁকিপূর্ণ।

জোয়ার-ভাটা শুধু নদীর পানিই বদলায় না, বদলায় তাদের ভাগ্যও। কখনো মাছ পেয়ে দু’বেলা খাবার জোটে, কখনো খালি হাতে ফিরতে হয়। দুর্যোগ, নদীভাঙন, দারিদ্র্য আর নিদারুণ কষ্ট তাদের নিত্যসঙ্গী।

স্থানীয় এক জেলে নারী সালেহা বেগম তাঁর ৭ বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে কাঁপা গলায় বলেন, “সকালেই পান্তা খাইছি। রাতে আল্লাহ যদি খাইয়ায়, তবেই খাবো। ছেলে-মেয়েরে নিয়ে বসে থাকলে চলবে কীভাবে? স্বামী-স্ত্রী দুইজনে মাছ ধরি, অনেকদিন তো মাছই পাই না। কবর দেওয়ার মতো জায়গাও আমাদের নাই।”

সালেহার এই কথাই যেন চান্দার খালের মানুষের লম্বা দুঃখগাথার প্রতিচ্ছবি। দীর্ঘদিনের নদীভাঙনে ঘরহারা এই মানুষগুলো বাধ্য হয়েই নৌকাকে স্থায়ী ঠিকানা করেছেন। গরমে দমবন্ধ, বৃষ্টিতে পানি, শীতে কাঁপুনি, প্রতিটি মৌসুমই যেন নতুন শত্রু হয়ে আসে।

বয়স্ক জেলে রমিজ উদ্দিন বলেন,“এই নদী আবার মা, আবার শত্রু। মাছ দেয়, আবার ঘরও নিয়ে যায়। তবুও নৌকা ছাড়া আমাদের আর কিছু নাই।”

সন্তানদের শিক্ষাজীবন এখানে সবচেয়ে ঝুঁকিতে। নৌকায় বই-খাতা নিয়ে পড়াশোনা অসম্ভব। স্কুলে ভর্তি হলেও যাতায়াতের ভয়াবহ ঝুঁকি থাকায় অধিকাংশ শিশু স্কুলমুখী হয় না। স্বাস্থ্যসেবার অবস্থাও ভয়াবহ, ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দির মতো সাধারণ রোগই বড় বিপদ হয়ে দাঁড়ায়।

জেলে মোহাম্মদ আফান সরদার বলেন, “নদীতেই বাচ্চারা জন্ম নেয়, নদীতেই বড় হয়। সারা বছরই সংগ্রাম; বর্ষা এলে সেই কষ্ট আরও বাড়ে।”

জেলে সমাজের প্রবীণ সদস্য আলাউদ্দিন ক্ষোভ নিয়ে বলেন, “৬৫ বছর নদীতেই আছি। কেউ খোঁজ নেয় না। বৃষ্টিতে ভিজি, রোদে শুকাই, আমরা কি মানুষ না?”

স্থানীয় যুবক সোহেল বলেন, “এটা কোনো একদিনের সমস্যা নয়। এরা অধিকারবঞ্চিত এক গোষ্ঠী। তাদের নিরাপদ বাসস্থান, খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, সবকিছুই সংকটে।”

সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার রাশেদ হাসান জানান, “চান্দার খাল এলাকায় নৌকায় থাকা অধিকাংশ পরিবারই প্রকৃত জেলে। আমরা তালিকা করছি, যাদের জেলে কার্ড নেই, দ্রুত দেওয়া হবে। কার্ড পেলে ভিজিডি চাল, সরকারি সহায়তা, প্রশিক্ষণ, উপকরণ,সবই নিশ্চিত করা যাবে। নদীভাঙন ও বাসস্থানের বিষয়ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানানো হবে।”

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেহেদী হাসান কাউছার বলেন, “নৌকায় বসবাসকারীদের দুর্দশা আমাদের নজরে আছে। যাদের ঘরবাড়ি নেই-তাদের পুনর্বাসন ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আনার উদ্যোগ চলছে। শিশুদের শিক্ষা বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশাসনের সব দপ্তর নিয়ে আমরা একটি স্থায়ী সমাধানের দিকে কাজ করছি।”

আরও খবর

Sponsered content